মা হওয়ার প্রথম দিন তো সেই টা, যেদিন আপনি জানতে পারলেন–“তুমি মা হতে যাচ্ছ!”
আমি যদি ভুল না করি, ঠিক সেই মূহুর্ত থেকে আপনার ভেতরে এক তোলপাড় চলছিল। এখন কি করবো? কাকে আগে বলবো! না না… তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আমাকে ধীর হতে হবে!এমন আরও অসংখ্য অস্থীরতা তখন হাওয়ার মতো বয়ে চলে। আর নিজেকে কেমন অতিথি অতিথি মনে হয় নিজের কাছেই।
হবে নাই বা কেন?! আপনি তো অপেক্ষায় ছিলেন…..আপনার মাঝে নিজের অস্বীত্বের আগমনের।
সন্তান আসবে এ কথা জানতে পারার পর থেকে সে জন্মানো পর্যন্ত যে সময়টা এর মাধুর্য্য অন্যরকম। আমার নিজের কথায় যদি বোঝাতে যাই, আমি বেশ একটা লম্বা সময় অপেক্ষা করে ছিলাম এই মুহূর্তটার জন্য। নিজের সব কাজ, সংসার, ব্যক্তি জীবন সব কিছুর মাঝে আমি একটা শূন্যতা অনুভব করতাম। স্বামী, সংসার, পরিবার আর আমি সবাই নিজ গতিতেই তো চলছি। তারপরও আনন্দ যেন ঠিক ভেতর থেকে আসে না। বছর ঘুরে যায়, ঈদ আসে, রোজা আসে, পহেলা বৈশাখ, ফ্লাগুন, থার্টি ফার্স্ট এ সব কিছু সব সময় জীবন যাপনের আনন্দ না। অনেক অনেক অভিযোগ মনের মধ্যে জমে যায়, সমাধান খুঁজে পাই না।
আমার এক বন্ধু বলছিল –“ আমার একটা বেবি থাকার সব থেকে বড় পাওয়া কি জানিস? আমি মারা গেলে কেউ আমার জন্য দোয়া করবে।“ এমন আরও অনেক রকম পূর্ণতার সংবাদ ছিল আমার সন্তান আগমনের খবর টা।
কেমন কাটে এই সময়টা?
গর্ভাবস্থা একজন মেয়ের জন্য সবথেকে সুন্দর এবং কঠিন একটা সময়। সুন্দর বলার কারণ তো অনেক। আর কঠিন বলছি কারণ মন মেজাজ কখনই ঠিক থাকে না এই সময়ে।
প্রথম তিন মাস বেশ কষ্ট হয়। শরীর টা খুব খারাপ লাগে। যাদের প্রথম প্রেগ্ন্যান্সি, তারা বেশি বুঝতে পারেন এই সময় এর খারাপ লাগাটা। বমি বমি ভাব বা খাবারে অরুচি খুব সাধারণ ঘটনা। এর জন্য ডাক্তার প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে দেন। এর সাথে শরীর দুর্বল লাগে, শরীর ভারী লাগে ইত্যাদি আরও অনেক রকম উপসর্গ দেখা দেয়। চিকিৎসক এর পরামর্শ নিয়ে সময় মতো খাওয়া দাওয়া করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা আর রেস্ট নেওয়া এই সময় এর মূল রুটিন।
এ সময় খাবার চাহিদা বেড়ে যায়,কিন্তু সব খাবার ভালো লাগে না। তবে খাওয়া জরুরি। তাই বলে যদিফাস্ট ফুড, জাংক ফুড, ভাজা পোড়া টাইপের খাবার বা অতিরিক্ত সুগার -কোলেস্টরেল যুক্ত খাবার বেছে নেওয়া একদম অনুচিত। এতে করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপনি এবং আপনার বেবি দুই জনই বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। এমনিতেই এই সময় মেয়েদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই সব সময় আপনাকে সচেতন থাকতে হবে যেন আপনার খাবার এবং জীবন যাপনে জন্য বাড়তি কোন ঝুঁকি না তৈরি হয়।
কাজ করা কি বারণ?
না কখনোই তা নয়, বরং নিজেকে সুস্থ ও ভালো রাখতে ঘরের হালকা কাজ গুলো যতটা পারেন নিজে থেকে করতে থাকবেন। এতে আপনার শরীর ও মন দুই ভালো লাগবে। অবশ্যই ভারি কাজ করবেন না, আবার ডা. আপনাকে যে বিষয় গুলো খেয়াল রাখতে বলবেন সে বিষয় গুলো মাথায় রেখে যতটা ভালো লাগে, ঠিক ততটুকু চলা ফেরাই করবেন। জোর দিয়ে কোন কাজ করবেন না। এ সময় টা নিজের এবং আপনার বাচ্চার যত্ন নেওয়া আপনাকেই শিখতে হবে।
নিজের যত্ন নেওয়া শিখতে হবে
- এই সময় টা তে শরীরে দূর্বলতা, অসুস্থ ভাব, সংসারের কাজের চাপ, পরিবারের অন্য মানুষ গুলোর অসহযোগিতা ইত্যাদি নানা রকম পরিস্থিত তৈরি হতে পারে যা আপনার মন খারাপ করে দিতে পারে। এমনিতেও এই সময় মন মানসিকতা খুব দূর্বল হয়ে যায়-
- কারোও কারোও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়
- যে কোন দুঃসংবাদ শুনলে হার্টবিট বেড়ে যায়।
- যে কোন নেগেটিভ কথা খুব প্রভাব ফেলে অনেক ক্ষেত্রে।
কোন কিছুই নির্ধারিত নয়। আশেপাশের মানুষ, বিশেষ করে হাজবেন্ড এর থেকে এই সময় সর্বাত্মক সাহযোগিতা আশা করে মেয়েরা। যদি পরিস্থিতি তেমন অনুকূল না হয়, তারপরও নিজের খেয়াল নিজেকে রাখতে হবে। যেমন-
- নিজের খাবার সময়মতো খেতে হবে।
- নিজের বিশ্রাম এর সময় টা নিজেকে বুঝতে হবে।
- কাজ গুলো যতটা সম্ভব গুছিয়ে করতে হবে, বা নিজের লিমিট বুঝে চলাফেরা করতে হবে।
- সব সময় নিজের ভেতর বড় হতে থাকা ছোট্ট বেবি টার জন্য কি ভালো হবে? সেটা ভাবতে হবে।
- বাচ্চার ও নিজের ভালোর জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশেষ করে যারা একা থাকন, তাদের নিজেদের রুটিন নিজেকেই সাজাতে হবে।
এই সময় যে শারিরীক কষ্ট গুলো হয়, তারমাঝেও কিছু ভালো লাগা থাকে। যেমন-
- বেবির হার্ট বিট,
- রুটিন চেক-আপে বেবির ডেভেলপমেন্ট,
- বেবির ওজন বাড়বে আর হাটা চলা তে কষ্ট বাড়বে।
তারপর ও দেখবেন আপনার খুব আনন্দ হবে মনে মনে বেবি ঠিকঠাক বাড়ছে বলে। আর যেদিন আপনি প্রথম মুভমেন্ট অনুভব করবেন, সেটা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এসব ই হচ্ছে প্রেগ্ন্যাসি কালীন আনন্দ। যা সারা জীবন এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে। এই বিশেষ সময়ে যদি কেউ একটু যত্ন নেয়, তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে যায় যেন। কারণ সে যেন আমার অনাগত বাচ্চাকে এখনই অনেক যত্ন করলো, এই অনুভূতি টা একটা মেয়ের কাছে প্রথম প্রেমের থেকেও বেশি প্রিয়। আর যদি কেউ জেনে শুনেও খুব দ্বায় সারা আচরণ করে, না দেখার মতো করে থেকে যায় তার প্রতি মনোভাব টাও তেমন ই বিরুপ হয়। ওই একই কারণে।
বৈষম্য!
যখন একটা হবু মা তার বাচ্চার জন্য নানা রকম রঙ বেরঙের জামা কিনছে। কিভাবে তাকে নিয়ে সময় কাটাবে আরও অনেক সুন্দর সুন্দর কল্পনা করে, এমন সময় যখন কেউ তার সামনে বলে “ছেলে না মেয়ে?” “প্রথমে যেন ছেলেই হয়!” “বাচ্চা কিন্তু ফর্সা হতে হবে”, “জাফরান দিয়ে দুধ খাও, ডিমের সাদা টা খাও, আমার ফর্সা নাতি লাগবে!”……. .এমন কথা শুলনে হবু মায়ের মনে কষ্ট আসাটাই স্বাভাবিক। যারা বলেন তারা নিজেকে বাচ্চার মায়ের সামনে ছোট করে দেন। তবে দূর্বল হলে চলবে না। আপনি মা হতে যাচ্ছেন, সামনে আরও কত কি আসবে, মন কে শক্ত রাখতে হবে! এসব উড়ো কথাকে পাত্তা দেয়া যাবে না।
পরিণত!
নিজের মন ভালো রাখার জন্য নিজেকেই কিছু বেসিক রুলস ফলো করতে হবে। যে কাজ করতে ভালো লাগে, যেভাবে সময় কাটাতে ভালো লাগে সেভাবে সময় কাটান। সাজগোজ করা, বই পড়া, ছবি আঁকানো, মুভি দেখা যার যা ভালো লাগে ঘরে বসে করার মতো তাই করুন। কারণ, গর্ভাবস্থায় মায়ের মনের পুরোপুরি প্রভাব বাচ্চার ওপর পড়ে।
তাই বলে সারাদিন ধরে শপিং করা, লং জার্নি তে বেরিয়ে পড়া, মন ভরে বাইরের খাবার খাওয়া, ইচ্ছে মতো ঠান্ডা পানি বা আইস্ক্রীম খাওয়া …… মন ভালো রাখতে এতো টা উদ্দ্যোমী হওয়া যাবে না আবার। বেবি অনেক নাজুক। অযত্ন তাদের সহ্য হয় না। তার ভালোর জন্য নিজেকে শাসন করতে শেখাটাও খুব জরুরি।
পজেটিভ থাকুন
সব সময় পজেটিভ চিন্তা ভাবনা ও কাজ করা উচিত এসময়। নিজের আচরণের মধ্যেও পজেটিভিটি রাখতে হবে। বিজ্ঞান বলে আপনি আপনার সন্তান কে যেমন টা দেখতে চান, গর্ভাবস্থায় নিজের মধ্যে তারই প্রতিফলন ঘটান। তাহলে বুঝে দেখুন এ সময় আপনি নিজেই নিজের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
মেয়ে থেকে মা হয়ে ওঠা
আসলে নিজেকে ভুলতে ভুলতেই একটা মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। মুখে যতটা বলছি, সে রকম সবটা সহজ নয়। মহান আল্লাহ এই নয় টা মাস একটা ট্রেনিং পিরিয়ড করে দেন একটা মেয়ের জন্য। না ঘুমিয়ে রাত জেগেও কি করে ঠান্ডা মাথায় দিন পার করা যায় তা একজন মা নিজে থেকেই শিখে যায়। নিজের পছন্দের খাবার থেকে কি ভাবে দূরে থাকা যায় কোন অনুযোগ ছাড়া। সবাই যখন ঘুরতে যাচ্ছে, নিজেকে ঘরে বন্দী রাখতে হয়। এগুলো কোনটা ই নিয়মিত নয়, পরিস্থিতি। তবে কম বেশি সবাই কেই কষ্ট করতে হয়। বেঢপ জামা কাপড় পরে চলাফেরা, চেহারার পরিবর্তন। এসবই গর্ভাবস্থার প্রভাব। সন্তান জন্ম দানের মূহুর্তের যে যন্ত্রণা তা তো শব্দ বা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কিন্তু, তাই বলে কোন মা পিছিয়ে যান না। অত্যন্ত উদ্যমী হয়ে তিনি হাসি মুখে এই কষ্ট বরণ করে নেন। আর সব ভুলে যান যখন ছোট্ট সোনামণি র মুখ দেখেন।
পরম আস্থা সৃষ্টিকর্তা
গর্ভাবস্থায় ইবাদতও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এতে মন শান্ত থাকে। ছোট্ট সোনামণি র সুস্থতা এবং নিরাপত্তার জন্য আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। তারপরও কিন্তু থেকে যায়, কারণ জীবনের সবটা তো আমাদের হাতে নেই। একজন মা ও এই ভাবনা তে প্রায় ই অস্থির হয়ে পড়েন। তখন যে যেই ধর্ম অনুসরন করে সেই ধর্ম অবলম্বন করেই সর্বোচ্চ শক্তি সৃষ্টিকর্তা কে স্মরণ করেন। যেন তার সন্তান জীবনের সর্বাবস্থাতেই সুস্থ, সুন্দর আর নিরাপদ থাকে।
আমাদের ইসলাম ধর্মে গর্ভাবস্থায় ইবাদতের অনেক গুরুত্ব আছে। সন্তান সম্ভবা অবস্থায় একজন মা এর দোয়া নাকি কখনও বিফল হয় না।
নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন
সময় খুব দ্রুতই চলে যায়, এই আট/নয় মাস পার হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তবে একজন মেয়ের জীবনে এর থেকে সুন্দর সময় মনে হয় আর কিছুই হয় না। অনেক মেয়ে কেই এমন সময়েও কঠিন সংগ্রাম করতে হয়, জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য, সন্তান রাখার জন্য। এ কঠিন পরিস্থিতি কারোও হাতে নেই। যারা একটা সুস্থ সুন্দর সময়ের মধ্যে গর্ভাবস্থায় আছেন, তারা অবশ্যই অনেক ভাগ্যবান।নিজের যত্ন নিন। নিজেকে সময় দিন। নিজের অবমূল্যায়ন করবেন না। একটা সুন্দর সোনামণি কে কোলে নেওয়ার মূহুর্ত টা পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করুন।
একজন মায়ের শারীরিক কষ্টের থেকেও মানসিক কষ্ট অনেক বেশি থাকে। হয়তো এর কোন সমাধান বা স্থায়ী প্রতিকার কোনদিন হবে না। তার কারণ, একজন মা নিজের মধ্যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন বলেই, আমরা নিজেদের অস্তীত্ব নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। এ এক শব্দহীন ভালোবাসা। যার কোন দেনা পাওনা নেই, চাওয়া পাওয়া র হিসেব নিকেশ নেই। শুধু এক তরফা বহিঃপ্রকাশ আছে। তবে সময় করে আমরা যদি আমাদের মা’দের মানে বয়স্ক মায়েদের একটু যত্ন নেই, তাতেই আমাদের মায়েরা অনেক খুশি হয়ে যান। এখানেও কারণ একটাই, আমার সন্তান আজকে আমরা যত্ন নিচ্ছে!!!
যত্ন নিন মায়েদের। নিজের মা, নতুন মা, হতে যাওয়া মা বা আপনার ছোট্ট সোনামণি টার। এই ভালোবাসা গুলো তোলা থাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হাত বদল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
Your writing is not only informative but also incredibly inspiring. You have a knack for sparking curiosity and encouraging critical thinking. Thank you for being such a positive influence!