খবরের কাগজ আদ্যোপান্ত পড়া আমার সরকারি চাকুরে বাবার দীর্ঘদিনের অভ্যাস, যেটা কিনা পাকাপোক্ত হয়েছে আরো অবসরে যাবার পর। যা কিছু ভালো খবর ছুটে এসে পড়তে দেন আমাদের। এসব ভালো খবরের ব্যাপকতা অসীম।
এই যেমন ‘বিশ্ব খ্যাত পরামর্শক চাটগাঁর ছেলে সুবির চৌধুরীর আকাশ ছোঁয়া’, ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন’, ‘আলোকচিত্রির মনের জোরে ক্যান্সার জয়’, ‘গাছগাছড়া থেকে অসুখ সারানো’, ‘ঢ্যাঁড়সের মহাগুণ’- সবই বাবার কাছে জরুরী খবর। সবকিছুই পড়তে দেন আমাদের। প্রতি বছর ‘গনিত অলম্পিয়াডে’ কে চ্যাম্পিয়ন হলো আমাকে জানতে হয়। পড়তে দেন হেলাল হাফিজের প্রেমের কবিতা’ও।রেল চাকুরির মায়া বা সিন্সিয়ারিটির বশে এখনো প্রতি বছরের নতুন টাইমটেবিল সংগ্রহে রাখেন। হাতের পাশের টেবিলে সাজানো থাকে রবীন্দ্রনাথ রচনাবলীর সন্মানে। মাঝে মাঝে ট্রেন যাত্রার সময়সূচি ঝালিয়েও নেন দরকার মতো।
সন্ধ্যায় আমি যখন অফিস থেকে ফিরি প্রথম আলো র ‘শব্দজব্দ’ হাতে দিয়ে আমার মোবাইল ফোনখানা জব্দ করে নেন। আমি ফেইসবুকহীন হয়ে সুডোকু মিলাই।
‘ওয়াল্টন এখন দেশের সীমা পেরিয়ে’পড়তে পড়তে হাই উঠে, ধরা খাবার ভয়ে পেপার লুকিয়ে ফেলি বালিশের তলায়।
সকলের সাফল্যের খবর পড়তে পড়তে একসময় নিজেকে গর্দভ শ্রেণীভুক্ত বলে মনে হয়।
বাবা মাঝে মাঝে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনির প্রস্তুতিমূলক মডেল টেস্টও পড়তে দেন, এটা জেনেশুনেও যে- আমি, বা আমার ছোট ভাইবোন, বা আমার সন্তানসন্ততি, এই তল্লাটে কেউ নেই পিএসসি পরিক্ষার্থী।
হা-হুতাশ আর হতাশার শেষ নেই এজন্য, বাংলাদেশের মেয়ে স্থায়ী ভাবে মঙ্গল গ্রহে থাকতে যাচ্ছে।
খোদ চট্টগ্রামের মেয়ে ‘ওয়াসফিয়া’ তরতর করে হিমালয় চুড়ায় উঠে পড়ে যখন খুশী। এমনকি সাকিব-আল-হাসান সেঞ্চুরি করলেও বাবা আমাদের দিকে চোখ গরম করে তাকান।
মনে পড়ে যেবার ইউনুস সাহেব শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেলেন, কি অশান্তিটাই না হয়েছিল আমাদের বাসায়। আমরা ভাইবোনেরা সন্ধ্যায় জোরসে পড়তে বসে গিয়েছিলাম যাতে বড় হয়ে নোবেল পুরষ্কার পাই।
মাস খানেক আগে দিনশেষে বাসায় ঢুকে দেখি বাবা ঘাপটি মেরে বসে আছেন, ভাঁজ করা পেপার হাতে- আঙ্গুলে দেখিয়ে দিলেন ‘সুইডিশ কিশোরী পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবারগের খবরটা।এই বুড়া বয়সে শিশু পরিবেশবিদ হবার আর কোন চান্স নেই। আমার ইচ্ছেও নেই।
বাবা আংগুল তুলে শাসাতে আসলে রাগ না লেগে আটকে যায় উনার ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলে। আঙ্গুলের মাথায় স্মৃতিশৌধের মত ত্রিকোণাকৃতি একটা কালচে জন্মদাগ তার। আমাদের সব ভাইবোনের অতি চেনা আর আপন সেই ছোট্ট স্মৃতিশৌধটা।
যদিও বাবার কালো কালো মোটা নরম আঙ্গুল গুলোও ভীষণ ভয় পাই আমরা ছোটবেলা থেকে।
ভীষণ রাগি বাবার কাছ ঘেঁষার সাহস খুব কম পেয়েছি আমরা। শুধু ঈদের জামা কেনার জন্য যখন নিউমার্কেট বা রিয়াজুদ্দিন বাজার নিয়ে যেতেন, ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়ে শক্ত করে ধরে রাখতেন আমাদের ছোট্ট হাতগুলো। আজো হয়তোবা তার পছন্দের খবর পড়ার উৎপাতটা সহ্য করি এটুকু সান্নিধ্যের আশায়।
আসলে বাবারা বোধকরি আজন্ম কারিগর। নিজে যা হয়েছেন, যা হতে পারেননি সবকিছু দেখতে চান সন্তানের মাঝে।
মাঝে সাঝে আমিও বাধ্য সন্তান হবার চেষ্টা করি। ২৫শে বৈশাখে ‘ঠাকুর বাড়ির রসুই থেকে দুই পদ’ এনে বাবা যখন বলেন ডাইরিতে টুকে রাখ, আমি শুধু টুকে রাখি না, রেসিপি ফলো করে জোড়াসাঁকো ফ্লেভারে ইলিশের পাতুরিও রান্না করে ফেলি।
এত কিছুর পরও শেষরক্ষা হয় না।
হঠাৎ করে বাড়ির পাশের অভিজিৎ ব্যানারজি বাবু’ রা খামাখা অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে বসেন, বাবা আর রাগ ধরে রাখতে পারেন না। —- রেগেমেগে বলেন ‘না তোরা নিজে কিছু করতে পারলি জীবনে… না পেলাম একটা নোবেল প্রাইজ পাওয়া মেয়েজামাই’।
Written by Taslima Muna